দাদ কি?, দাদ হওয়ার কারণ, দাদের ধরন, দাদের লক্ষণ, দাদের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

দাদ কি?
শারীরিক দাদ একটি ত্বকের রোগ, যা সাধারণত ছত্রাকজনিত (fungal) সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে। এটি ত্বকে নানা ধরনের চুলকানি, লালচে বা সাদা দাগ সৃষ্টি করে এবং একে ত্বকের ফাঙ্গাল ইনফেকশন বলা হয়। দাদ সাধারণত আক্রান্ত অংশের আশপাশে চুলকানি, ফোস্কা বা খোসপাচড়া সৃষ্টি করতে পারে।
দাদ আক্রান্ত স্থানে সাধারণত দেখতে পাওয়া যায়:
লালচে বা সাদা দাগ বা গোলাকার দাগ
চুলকানি বা গাঢ় চুলকানি হয়
ফোস্কা বা খোসপাচড়া হতে পারে
কিছু ক্ষেত্রে ত্বক শুকিয়ে যেতে পারে বা ফাটা ফাটা হতে পারে
দাদ সাধারণত শরীরের যেসব অংশে বেশি ঘামে বা আর্দ্রতা থাকে, সেসব জায়গায় বেশি হয়, যেমন পা, হাতের আঙ্গুল, গলার নীচে, বা শারীরিক ম্যানিজমেন্ট অঞ্চল।
দাদ হওয়ার কারণ:
দাদ হওয়ার কিছু সাধারণ কারণ রয়েছে, যা ত্বকে ছত্রাকজনিত সংক্রমণ সৃষ্টি করে। এর প্রধান কারণগুলো হলো:
ছত্রাক সংক্রমণ: দাদ মূলত ছত্রাক (fungus) দ্বারা হয়। ছত্রাক ত্বকের বাইরের স্তরে বৃদ্ধি পায় এবং চুলকানি, লালচে দাগ, বা সাদা ফুসকুড়ির সৃষ্টি করতে পারে। এই ছত্রাক সাধারণত আর্দ্র বা গরম পরিবেশে দ্রুত বাড়ে।
অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন:
ত্বক পরিষ্কার না রাখা
দীর্ঘ সময় ধরে ভেজা কাপড় পরিধান করা (যেমন, ঘামে ভেজা জামা বা স্নান না করা)
অস্বাস্থ্যকর বা অপরিষ্কার পোশাক পরা
উচ্চ আর্দ্রতা: বেশি গরম এবং আর্দ্র পরিবেশে, যেমন গ্রীষ্মকালে বা এমন স্থানে যেখানে ঘাম বেশি হয়, সেখানে দাদ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
পায়ের ত্বকে সমস্যা: পায়ে বেশি ঘাম হওয়া এবং পায়ের আর্দ্র পরিবেশ দাদ হওয়ার অন্যতম কারণ। সাধারণত পায়ের ফাঙ্গাস (athlete’s foot) দাদ সৃষ্টি করে থাকে।
অ্যালার্জি বা ত্বকের প্রতিক্রিয়া: ত্বকে কোনো বিশেষ জিনিস বা উপাদানের অ্যালার্জি (যেমন: কিছু প্রসাধনী, সাবান, বা কাপড়) থাকার কারণে দাদ হতে পারে।
অতিরিক্ত ঘাম বা শরীরী আর্দ্রতা: যে সব জায়গায় বেশি ঘাম হয়, যেমন হাত, পা, গলা, বা ত্বকের অন্যান্য ভাঁজ, সেখানে ছত্রাক দ্রুত বেড়ে যেতে পারে এবং দাদ সৃষ্টি করতে পারে।
দূষিত পরিবেশ: যেখানে স্যাঁতসেঁতে এবং অপরিষ্কার পরিবেশ থাকে, যেমন সাঁতার সেকশনের পুল, পাবলিক টয়লেট, বা গরম ও আর্দ্র পরিবেশে, সেখানে ছত্রাকের সংক্রমণ হওয়া সহজ।
দূর্বল ইমিউন সিস্টেম: যাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউন সিস্টেম) দুর্বল, যেমন ডায়াবেটিস বা এইচআইভি আক্রান্ত রোগী, তাদের দাদ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
অন্যান্য ত্বকের রোগ: ত্বকের অন্যান্য রোগ বা সমস্যার কারণে যেমন একজিমা বা অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস থাকলে দাদ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
দাদ থেকে বাঁচার উপায়:
ত্বক পরিষ্কার ও শুষ্ক রাখা
আর্দ্র বা গরম পরিবেশে সতর্ক থাকা
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা এবং সঠিক খাবার খাওয়া
অপরিষ্কার জামা বা পোশাক পরা থেকে বিরত থাকা
প্রয়োজনীয় সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া
দাদের ধরন:
দাদ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, এবং প্রতিটি ধরন তার নিজস্ব উপসর্গ ও প্রভাব দেখায়। এখানে দাদের প্রধান ধরনগুলো আলোচনা করা হলো:
1. টিনিয়া করপোরিস (Tinea corporis)
বর্ণনা: এটি ত্বকের উপর গোলাকার বা আঙ্গুলের আকারে দাগ সৃষ্টি করে। দাগগুলো সাধারণত লালচে বা সাদা হয় এবং এর চারপাশে ছোট ছোট ফুসকুড়ি দেখা যায়।
স্থানে: সাধারণত শরীরের ওপরে, পিঠ, পেট, কাঁধ বা হাতের পেছনের অংশে দেখা যায়।
2. টিনিয়া ক্রুরিস (Tinea cruris)
বর্ণনা: এটিকে “জকাইট” বা “ফার্মারস ডার্মাটাইটিস”ও বলা হয়। এটি ত্বকের ভাঁজে (যেমন, অন্ডকোষ, উরু, পেটের নীচে) হতে পারে এবং এখানে ত্বক লাল হয়ে চুলকানি হয়।
স্থানে: সাধারণত উরুর অভ্যন্তরীণ অংশ, জাং বা যৌনাঙ্গের আশপাশে।
3. টিনিয়া পেডিস (Tinea pedis)
বর্ণনা: এটি পায়ের দাদ বা “এথলিটস ফুট” নামেও পরিচিত। এতে পায়ের তলায় ও আঙ্গুলের মধ্যে চুলকানি এবং ফুসকুড়ি সৃষ্টি হয়।
স্থানে: পায়ের পাতায়, আঙ্গুলের মধ্যে, পায়ের আঙুলের উপরিভাগে এবং পায়ের তলায়।
4. টিনিয়া ইউনগুইয়াম (Tinea unguium)
বর্ণনা: এটি নখের দাদ বা অংগুলির দাদ নামে পরিচিত। এতে নখের রঙ পরিবর্তিত হয় এবং নখ ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থা হতে পারে।
স্থানে: হাত বা পায়ের নখের ওপর।
5. টিনিয়া ক্যাপিটিস (Tinea capitis)
বর্ণনা: এটি মাথার দাদ নামে পরিচিত। এতে চুলের গোড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং চুল পড়তে পারে। সাধারণত এটি শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
স্থানে: মাথার ত্বকে, বিশেষত স্কাল্পের (চুলের গোড়া) চারপাশে।
6. টিনিয়া ভারসিকলার (Tinea versicolor)
বর্ণনা: এটি একটি ছত্রাকজনিত ত্বক সমস্যা যা ত্বকে সাদা বা গোলাপি, বাদামী রঙের দাগ সৃষ্টি করে। এই দাগগুলো সাধারণত শরীরের উপরের অংশে (যেমন, পিঠে বা বুকের ত্বকে) দেখা যায়।
স্থানে: শরীরের উপরের অংশে, বিশেষত পিঠ, গলা বা বুকের ত্বকে।
7. ডার্মাটোফাইটসিস (Dermatophytosis)
বর্ণনা: এটি একটি সাধারণ ছত্রাক সংক্রমণ যা দাদ সৃষ্টি করে। এটি বিভিন্ন ত্বক, নখ এবং চুলের অংশে হতে পারে।
স্থানে: দেহের নানা অংশে হতে পারে, তবে বিশেষত পা, গলা, উরু, মাথা এবং শরীরের অন্যান্য অংশে।
8. এন্ট্রোপিক ফাঙ্গাল ইনফেকশন (Endophytic Fungal Infection)
বর্ণনা: এই ধরনের দাদ ছত্রাক ত্বকের গভীরে প্রবেশ করে এবং গভীর ত্বককে আক্রান্ত করে। এটি সাধারণত ক্ষতিকর এবং রোগীর শরীরের অন্যান্য অঙ্গও আক্রান্ত হতে পারে।
স্থানে: ত্বকের গভীরে অথবা সংক্রমিত জায়গার আশপাশে।
দাদের লক্ষণ:
দাদ (fungal infection) হওয়া সাপেক্ষে বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ দেখা যায়, তবে সাধারণ কিছু লক্ষণ রয়েছে যেগুলি প্রায় সব ধরনের দাদেই দেখা যেতে পারে। দাদের লক্ষণগুলির মধ্যে প্রধান প্রধান গুলি হল:
1. চুলকানি:
দাদের প্রধান লক্ষণ হলো ত্বকে চুলকানি। আক্রান্ত স্থানে চুলকানি হওয়া খুব সাধারণ, এবং এটি আরও বাড়তে পারে যখন ত্বক ঘামে বা আর্দ্র থাকে।
2. লালচে বা গোলাকার দাগ:
দাদ সাধারণত ত্বকে লালচে বা গোলাকার দাগ সৃষ্টি করে। এই দাগের চারপাশে মাঝে মাঝে লালচে বা ফুসকুড়ি দেখতে পাওয়া যায়।
3. সাদা বা সোনালী রঙের দাগ:
টিনিয়া ভারসিকলার (Tinea versicolor) নামে পরিচিত এক ধরনের দাদে সাদা বা সোনালী রঙের দাগ দেখা যায়, যা সাধারণত শরীরের উপরের অংশে দেখা যায়, বিশেষ করে পিঠ, গলা এবং বুকের ত্বকে।
4. ফুসকুড়ি বা ফোলা ত্বক:
দাদ আক্রান্ত স্থানে সাধারণত ফুসকুড়ি দেখা দেয়। ফুসকুড়ি চুলকানি বা ত্বকের গাঢ়ত্বের সাথে হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, এটি ফেটে গিয়ে পুঁটলি বা ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে।
5. খোসপাচড়া বা শুষ্ক ত্বক:
দাদ আক্রান্ত জায়গায় ত্বক শুষ্ক হয়ে খোসপাচড়া হতে পারে। আক্রান্ত স্থানে ত্বক বিবর্ণ হয়ে যায় এবং খসখসে হয়ে ওঠে।
6. গন্ধ:
কিছু ধরনের দাদ সংক্রমণের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে পায়ের দাদ (Tinea pedis) বা জাং দাদ (Tinea cruris), সেখানে অস্বস্তিকর গন্ধ সৃষ্টি হতে পারে, যা ঘাম এবং আর্দ্রতার কারণে বেড়ে যায়।
7. চুল পড়া:
মাথার দাদ (Tinea capitis) ক্ষেত্রে, দাদ চুলের গোড়ায় সংক্রমণ সৃষ্টি করে এবং এর ফলে চুল পড়া বা চুলে ক্ষতি হতে পারে। এই ক্ষেত্রে চুলের গোড়ায় ক্ষত বা শিরশিরে ভাব থাকতে পারে।
8. অন্য কোনো অস্বস্তি বা ব্যথা:
কিছু ক্ষেত্রে, দাদ সংক্রমণ গুরুতর হতে পারে এবং তা ব্যথা বা অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে যদি ইনফেকশন গভীর হয়ে যায়।
9. প্রতিরোধহীন আর্দ্রতা:
দাদ আক্রান্ত জায়গা আর্দ্র বা স্যাঁতসেঁতে থাকতে পারে, যা ছত্রাকের বৃদ্ধিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এতে চুলকানি এবং ত্বকের ক্ষতি আরও বেড়ে যায়।
দাদের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা:
দাদ (fungal infection) এর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে, তবে হোমিওপ্যাথি ব্যবহারের আগে একজন অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। হোমিওপ্যাথিতে প্রতিটি রোগীর লক্ষণ ও শরীরের পরিস্থিতি অনুযায়ী চিকিৎসা নির্ধারণ করা হয়, তাই ব্যক্তিগত অবস্থার উপর ভিত্তি করে উপযুক্ত ঔষধ বাছাই করা হয়।
তবে, দাদ বা ফাঙ্গাল ইনফেকশন এর জন্য কিছু সাধারণ হোমিওপ্যাথিক ঔষধের উদাহরণ দেওয়া হলো:
1. ক্যালকেরিয়া কারব (Calcarea carb)
লক্ষণ: যদি দাদ ত্বকে সাদা দাগ সৃষ্টি করে এবং শরীরে আর্দ্রতা বা ঘাম বেশি থাকে, তবে এই ঔষধটি উপকারী হতে পারে। এটি সাধারণত শিশুর দাদ বা ত্বকের সংক্রমণের জন্য ব্যবহৃত হয়।
2. টিনিয়া টোমেটা (Tinea Tomentosa)
লক্ষণ: এটি প্রধানত মাথার ত্বকে, চুলের গোড়ায় বা স্কাল্পে ছত্রাক সংক্রমণের জন্য ব্যবহার করা হয়। যদি মাথার ত্বকে চুল পড়া এবং দাগ দেখা যায়, তবে এই ঔষধটি কার্যকর হতে পারে।
3. সিলিকা (Silicea)
লক্ষণ: যদি দাদ শুষ্ক, ফাটল, বা খোসপাচড়া সৃষ্টি করে, তাহলে সিলিকা ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি ত্বকের ক্ষত বা চুলকানি কমাতে সহায়ক হতে পারে।
4. অ্যারসেনিকাম অ্যালবাম (Arsenicum album)
লক্ষণ: এটি যখন ত্বকে লালচে দাগ, ফুসকুড়ি বা অস্বস্তি দেখা দেয় এবং রোগীর শরীর দুর্বল বা ক্লান্ত অনুভূত হয়, তখন অ্যারসেনিকাম অ্যালবাম সাহায্য করতে পারে। এটি ত্বকের চুলকানি এবং জ্বালাপোড়া কমায়।
5. রাসটক্স (Rhus toxicodendron)
লক্ষণ: যদি দাদের সাথে তীব্র চুলকানি, ফুসকুড়ি, এবং ত্বকে লালচে দাগ দেখা দেয়, তবে রাসটক্স ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি ত্বকের সমস্যা, বিশেষ করে আর্দ্র বা স্যাঁতসেঁতে ত্বকের জন্য উপকারী।
6. প্যাসিফ্লোরা (Passiflora)
লক্ষণ: যদি দাদের সংক্রমণ রাতে বেশি হয়ে থাকে এবং রোগী উদ্বিগ্ন বা মানসিকভাবে চাপগ্রস্ত থাকে, তবে প্যাসিফ্লোরা উপকারে আসতে পারে।
7. আলুম সিপা (Allium cepa)
লক্ষণ: এই ঔষধটি বিশেষভাবে ত্বকের ফাঙ্গাল ইনফেকশন এবং চুলকানির জন্য উপকারী। এটি ত্বকের জ্বালাপোড়া, চুলকানি কমায় এবং সংক্রমণ সারাতে সাহায্য করে।
8. Tellurium Matalicum:
9. Tuberculinum Bovinum:
10. Tuberculinum Bcilinum: