আমাশয় কি?, আমাশয় কারণ, আমাশয় ধরন, আমাশয় লক্ষণ, হোমিওপ্যাথিতে আমাশার চিকিৎসা

আমাশয় কি?
“আমাশয়” সাধারণত একটি প্রচলিত বাংলা শব্দ যা পেটের অসুখ বা শারীরিক অস্বস্তি বোঝানো হয়, বিশেষত গ্যাস্ট্রিক যা হজমে সমস্যা, অজীর্ণতা, অথবা পেটের ব্যথা সৃষ্টি করে। পেট ফাঁপা, বমি বমি ভাব, গ্যাস, অ্যাসিডিটি, এটি কখনো কখনো ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্যের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে।
এটি সাধারণত খাবারের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে, তবে এর কারণ হতে পারে জীবাণু, ভাইরাস, বা অতিরিক্ত টেনশনও। চিকিৎসকের কাছে পরামর্শ নেওয়া উচিত যদি সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়।
আমাশয় কারণ:
আমাশয়ের (পেটের অসুবিধা বা গ্যাস্ট্রিক সমস্যা) অনেক কারণ থাকতে পারে। এখানে কিছু সাধারণ কারণ উল্লেখ করা হলো:
১. অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস:
অতিরিক্ত তেল বা মশলাযুক্ত খাবার: বেশি মশলা, তেল, ফাস্ট ফুড বা চিজ জাতীয় খাবার খেলে পেটের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
অতিরিক্ত চিনি বা ক্যাফেইন: খুব বেশি চা, কফি বা মিষ্টি খাওয়ার কারণে পেটের সমস্যা হতে পারে।
খাবারের সময় নিয়মের অভাব: অল্প সময়ের মধ্যে অনেক খাবার খাওয়া বা খাওয়ার সময় নিয়ম না মেনে চলা।
২. হজমের সমস্যাগুলি:
অজীর্ণ (Indigestion): খাবার সঠিকভাবে হজম না হওয়া, ফলে পেট ফুলে যাওয়া, গ্যাস, অ্যাসিডিটি বা পেট ব্যথা হতে পারে।
গ্যাস: খাবারে গ্যাস তৈরি হওয়া, যা পেট ফাঁপা বা অস্বস্তির সৃষ্টি করে।
৩. মানসিক চাপ বা উদ্বেগ:
মানসিক চাপ, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি কারণে পেটের অঙ্গগুলি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। এটি গ্যাস্ট্রিক বা হজমের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
৪. ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া:
ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমণ হলে (যেমন, খাবারের মাধ্যমে) পেট খারাপ হতে পারে, যার ফলে ডায়রিয়া, বমি বা পেটের ব্যথা হতে পারে।
৫. অল্প পানি খাওয়া:
শরীরে পানির অভাব পেটের সমস্যা তৈরি করতে পারে, কারণ পানি হজম প্রক্রিয়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৬. অতিরিক্ত অ্যালকোহল বা ধূমপান:
অ্যালকোহল বা ধূমপান গ্যাস্ট্রিক সমস্যা বাড়াতে পারে, এবং পেটের সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে।
৭. হরমোনাল পরিবর্তন:
নারীদের মধ্যে পিরিয়ডের সময় হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে পেটে অস্বস্তি বা গ্যাসের সমস্যা হতে পারে।
৮. অন্য শারীরিক সমস্যা:
পেটের সমস্যা কখনো কখনো কিছু অন্যান্য শারীরিক সমস্যার ফলেও হতে পারে, যেমন গ্যাস্ট্রিক আলসার, ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (IBS), বা গ্যাস্ট্রোইসোফ্যাগাল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD)।
৯. অনিয়ন্ত্রিত ডায়েট বা খাদ্য এলার্জি:
কিছু খাবারের প্রতি অ্যালার্জি বা সংবেদনশীলতা থাকলে (যেমন, দুধ, গ্লুটেন ইত্যাদি), সেগুলি পেটে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
আমাশয় ধরন:
আমাশয়ের বিভিন্ন ধরন বা শারীরিক সমস্যা রয়েছে, যা পেটের অস্বস্তি, হজমের সমস্যা বা গ্যাস্ট্রিক ট্রাবল সৃষ্টি করে। এটি সাধারণত কিছু উপসর্গ অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। কিছু প্রধান ধরন নিচে উল্লেখ করা হলো:
১. গ্যাস্ট্রিক আমাশয় (Acidic Amashoy):
লক্ষণ: গ্যাস, পেট ফাঁপা, বুক জ্বালাপোড়া, অস্বস্তি, হালকা পেটব্যথা।
কারণ: অতিরিক্ত অ্যাসিডের কারণে হজমে সমস্যা তৈরি হয়। খারাপ খাবার বা অতিরিক্ত মশলাদার খাবারের কারণে এই সমস্যা বাড়ে।
২. অজীর্ণ (Indigestion):
লক্ষণ: পেট ভারী বা ফাঁপা অনুভব হওয়া, পেটের উপরের অংশে অস্বস্তি বা ব্যথা, খাবার হজম না হওয়া।
কারণ: খাবার সঠিকভাবে হজম না হওয়া। কখনো কখনো মানসিক চাপও এই সমস্যার কারণ হতে পারে।
৩. ডায়রিয়া (Diarrhea):
লক্ষণ: ঘন ঘন পেট খারাপ হওয়া, পাতলা পায়খানা, পেট ব্যথা।
কারণ: ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, অস্বাস্থ্যকর খাবার বা পানীয় খাওয়ার ফলে ডায়রিয়া হতে পারে।
৪. কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation):
লক্ষণ: পেটের নিচে চাপ বা ব্যথা, নিয়মিত পায়খানা না হওয়া, পায়খানা কঠিন হওয়া।
কারণ: পানি বা আঁশজাতীয় খাবারের অভাব, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন বা ঘুমের অভাব কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ হতে পারে।
৫. গ্যাস্ট্রিক আলসার (Gastric Ulcer):
লক্ষণ: পেটের মধ্যে তীব্র বা মাঝারি ব্যথা, বিশেষ করে খাবার খাওয়ার পর।
কারণ: অতিরিক্ত অ্যাসিড, দীর্ঘদিন ধরে পেটের ওষুধ বা অ্যালকোহল ব্যবহারের কারণে গ্যাস্ট্রিক আলসার হতে পারে।
৬. গ্যাস্ট্রোইসোফ্যাগাল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD):
লক্ষণ: বুক জ্বালা, গ্যাস্ট্রিক এসিড মুখে উঠে আসা, গলার ব্যথা বা খারাপ স্বাদ।
কারণ: পেটের অ্যাসিড খাদ্যনালি (ইসোফাগাস) পর্যন্ত উঠে আসার ফলে এই সমস্যা দেখা দেয়।
৭. ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (IBS):
লক্ষণ: পেটের নিচের অংশে ব্যথা, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাস।
কারণ: এই সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী পেটের অস্বস্তি তৈরি করে, যা মানসিক চাপ বা খাদ্যাভ্যাসের কারণে হতে পারে।
৮. পেট ফাঁপা বা গ্যাস:
লক্ষণ: পেটে গ্যাসের জমা, ফাঁপা ভাব, অস্বস্তি, বেলচিং (তিনবার বেলচ করা)।
কারণ: হজম প্রক্রিয়ায় গ্যাস তৈরি হওয়া। এটি সাধারণত খাবারের সাথে সংক্রান্ত সমস্যা, যেমন তেলযুক্ত বা মশলাদার খাবার খাওয়া বা অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে হতে পারে।
৯. ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ:
লক্ষণ: পেট ব্যথা, বমি, ডায়রিয়া, জ্বর, অজ্ঞান ভাব।
কারণ: ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পেটের সমস্যা হতে পারে। এটি সাধারণত অপবিত্র খাবার বা পানি খাওয়ার কারণে হতে পারে।
আমাশয় লক্ষণ:
আমাশয়ের (পেটের অস্বস্তি বা গ্যাস্ট্রিক সমস্যার) বিভিন্ন লক্ষণ হতে পারে, যা খাবারের পরিপ্রেক্ষিতে বা হজমের সমস্যার কারণে সৃষ্টি হয়। নিচে কিছু সাধারণ লক্ষণ উল্লেখ করা হলো:
১. পেটের ব্যথা বা অস্বস্তি:
পেটের নিচের অংশ বা উপরের অংশে ব্যথা অনুভব করা।
কিছু খাবার বা পানীয় খাওয়ার পর পেটের অস্বস্তি বাড়তে পারে।
২. গ্যাস বা পেট ফাঁপা:
পেটে গ্যাস জমে গিয়ে ফাঁপা ভাব বা অস্বস্তি সৃষ্টি হওয়া।
বার বার বেলচিং (এয়ার বের হয়ে আসা) বা পেট থেকে গ্যাস বের হওয়া।
৩. বমি বা বমি বমি ভাব:
খাবার হজম করতে সমস্যা হওয়া এবং বমি বমি ভাব অনুভব করা।
কখনো কখনো খাওয়ার পরপরই বমি হতে পারে।
৪. ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য:
হজমের সমস্যা হলে ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
পেট খারাপ হলে বার বার পায়খানা হতে পারে, বা একেবারে হজম না হওয়ার কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে।
৫. বুক জ্বালাপোড়া:
বুকের মধ্যে জ্বালাপোড়া বা অস্বস্তি অনুভব হওয়া, বিশেষত খাবার খাওয়ার পর বা রাতে।
এটি অ্যাসিড রিফ্লাক্স বা গ্যাস্ট্রিক আলসারের কারণে হতে পারে।
৬. অজীর্ণ (Indigestion):
খাবার হজম না হওয়া, পেট ভারী অনুভব হওয়া বা অস্বস্তি সৃষ্টি হওয়া।
খাবারের পর অস্বস্তি বা গ্যাসের অনুভূতি।
৭. মুখে খারাপ স্বাদ বা গন্ধ:
খাবার হজমে সমস্যা হলে মুখে তিক্ত বা খারাপ স্বাদ আসতে পারে।
কখনো কখনো অস্বাভাবিক গন্ধও আসতে পারে।
৮. শরীর দুর্বল বা অস্থিরতা:
পেটের সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে শরীরে দুর্বলতা বা অস্থিরতা অনুভূত হতে পারে।
খাওয়ার পর তীব্র ক্লান্তি বা শক্তিহীনতা অনুভব হওয়া।
৯. বাড়তি পানি পান বা পানির অভাব:
কিছু ক্ষেত্রে, পেটের সমস্যার কারণে শরীরে জলশূন্যতা (ডিহাইড্রেশন) হতে পারে।
এ ক্ষেত্রে পানির অভাব বা অতিরিক্ত পানি পান করতে হতে পারে।
হোমিওপ্যাথিতে আমাশার চিকিৎসা:
হোমিওপ্যাথিতে আমাশয় (পেটের অস্বস্তি, গ্যাস্ট্রিক সমস্যা, অজীর্ণতা ইত্যাদি) এর চিকিৎসা জন্য বিভিন্ন উপকরণ বা ঔষধ ব্যবহার করা হয়, যা রোগীর শারীরিক, মানসিক এবং আবেগিক অবস্থা অনুযায়ী নির্বাচন করা হয়। হোমিওপ্যাথি একটি স্বতন্ত্র চিকিৎসা পদ্ধতি যা শরীরের সামগ্রিক ভারসাম্য ফেরাতে সাহায্য করে।
হোমিওপ্যাথিতে আমাশয় চিকিৎসার জন্য কিছু সাধারণ ওষুধের নাম:
১. Nux Vomica:
ব্যবহার: এটি পেটের গ্যাস্ট্রিক সমস্যা, অজীর্ণতা, গ্যাস, বুক জ্বালাপোড়া এবং অতিরিক্ত মশলাদার বা তেলযুক্ত খাবার খাওয়ার কারণে অস্বস্তি হওয়া রোগীদের জন্য উপকারী।
লক্ষণ: বিরক্তি, উদ্বেগ, অতিরিক্ত খাবার খাওয়া, অতিরিক্ত অ্যালকোহল বা ক্যাফেইন গ্রহণ, বমি বমি ভাব।
২. Pulsatilla:
ব্যবহার: এটি সাধারণত স্নায়বিক বা মানসিক চাপের কারণে পেটের সমস্যায় সহায়ক। এটি বিশেষত যারা মিষ্টি খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হন তাদের জন্য উপকারী।
লক্ষণ: পেট ফুলে যাওয়া, গ্যাস, অজীর্ণতা, বা পেটের ব্যথা যা খাওয়ার পর বাড়ে।
৩.Arsenicum album:
ব্যবহার: এটি পেটের অসুখ, ডায়রিয়া, বমি এবং গ্যাস্ট্রিক সমস্যায় ব্যবহৃত হয়। এটি এমন রোগীদের জন্য উপকারী যারা ক্ষুধামন্দা অনুভব করেন এবং খাওয়ার পর অস্বস্তি পান।
লক্ষণ: বমি, পেটের ব্যথা, দুর্বলতা, ক্লান্তি, জ্বালা-পোড়া অনুভব।
৪. Rheum:
ব্যবহার: এটি কোষ্ঠকাঠিন্য এবং পেট ফাঁপা সমস্যায় সাহায্য করে। এটি শিশুর জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে, যাদের ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা রয়েছে।
লক্ষণ: কোষ্ঠকাঠিন্য, পেট ফাঁপা, পায়খানা কঠিন হওয়া।
৫. Calcarea Carbonica:
ব্যবহার: এটি শরীরের শক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য এবং হজমের সমস্যার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি পেটের সমস্যার কারণে সৃষ্ট দুর্বলতা বা ক্লান্তি অনুভূতি মোকাবিলা করতে সাহায্য করে।
লক্ষণ: শারীরিক দুর্বলতা, অতিরিক্ত ঘুম, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য।
৬. Lycopodium:
ব্যবহার: এটি পেটের গ্যাস, অজীর্ণতা, এবং খাদ্য হজমে সমস্যায় সাহায্য করে। এটি বিশেষত গ্যাস এবং পেটের ফাঁপার জন্য উপকারী।
লক্ষণ: পেটের নিচে চাপ, গ্যাস, পেট ফুলে যাওয়া, খাবার খাওয়ার পর অস্বস্তি।
৭. Sulphur:
ব্যবহার: এটি গ্যাস্ট্রিক সমস্যা এবং বুক জ্বালাপোড়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি অ্যাসিডিটির কারণে পেটের সমস্যায় সহায়ক।
লক্ষণ: বুক জ্বালাপোড়া, গ্যাস্ট্রিক এসিডিটি, পেট ফুলে যাওয়া।
৮.Arsenicum album:
ব্যবহার: এটি বমি বমি ভাব, গ্যাস্ট্রিক সমস্যা, এবং পেটের ব্যথার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি সাধারণত শারীরিক দুর্বলতা এবং ক্লান্তি দূর করতে সহায়ক।
লক্ষণ: বমি, গ্যাস্ট্রিক সমস্যা, পেটের ব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা।
৯. Colocynthis:
ব্যবহার: এটি পেটের তীব্র ব্যথা, গ্যাস্ট্রিক সমস্যা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এটি পেটের গ্যাসের কারণে হওয়া ব্যথা ও অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করে।
লক্ষণ: তীব্র পেটব্যথা, গ্যাস, পেটের সংকোচন, অস্বস্তি।